ইরানের সামরিক শক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ১০ টি সামরিক শক্তির দেশবন্ধুরা আজকে এই আর্টিকেলটিতে ইরানের সামরিক শক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। যদি আপনারা প্রশ্ন করেন সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা কেন? তাহলে এর একটাই উত্তর দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্যই একটা সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন হয়। বিশ্বজুড়ে সামরিক ভাবে ক্ষমতাবান যেই দেশ হবে সেই দেশী পৃথিবীর কর্তৃত্ব নিয়ে নিবে।

ভুমিকা

সমর বিশেষজ্ঞদের রিপোর্টগুলো থেকে জানা যায় ইরান সামরিক শক্তিতে পৃথিবীতে ১৪তম স্থানে রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির অবস্থান প্রথম স্থানে রয়েছে।তাই সামরিক শক্তিতে বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রকেও একহাত দেখিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে দেশটি।ইরানিয়ান বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ঊর্ধতন কর্মকর্তারা বলছেন, ইরান প্রতিদিন ২০ হাজার মিসাইল উৎক্ষেপনে সক্ষম।
গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যে যুক্তরাষ্ট্রের ২১ টি ঘাঁটি রয়েছে, সব সামরিক ঘাঁটি গুলো ইরানের মিসাইলের আওতায় রয়েছে। তারা আরোও বলেন এর চেয়েও ইরানের সক্ষমতা আরোও বেশি। যুক্ত যদি কোনো কারনে বেঁধে যায় তাহলে এর চেয়েও বেশি মিসাইল ইরান ছুঁড়তে সক্ষম।যেকোনো বড় যুদ্ধ ও শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইরান প্রস্তুত।

আজকের আর্টিকেলটিতে ইরানের সামরিক শক্তি নিয়ে আলোচনা করবো।

ইরানের সেনাবাহিনীর

ইরানে বর্তমানে সক্রিয় সেনা সদস্য রয়েছে ৫ লক্ষ ২৩ হাজার। সংরক্ষিত সদস্য সংখ্যা ৩ লক্ষ ৫০ হাজার।International Institute For Strategic Studies (IIRSS)একটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার Islamic Revolutionary Guard Corps (IRGC) সেনা রয়েছে ইরানের। IRGC ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী সামরিক ফোর্স।

ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (IRGC) এর কাঠামো

প্রায় চল্লিশ বছর আগে ইরানে শাহের শাসনের অবসান ঘটিয়ে যখন ধর্মীয় নেতারা ক্ষমতায় বসেন তাদের শাসন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য গঠন করা হয়েছিলো ইসলামিক রেভ্যুলশনারি গার্ড কর্পস বা IRGC। আস্তে আস্তে এই বিপ্লবী গার্ড দেশটির সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে বেশী প্রভাবশালী হয়ে উঠে।
প্রচলিত সেনাবাহিনীর উপর পুরোপুরি বিশ্বাস না থাকার কারনে এই বাহিনী গড়ে উঠে। যা পরবর্তীতে বিপ্লবী শাসন ব্যবস্থার ধারাকে অব্যাহত রাখতে সহয়তা করে।১৯৭৯ সালের পূর্বে অর্থাৎ বিপ্লবের আগে রেজা শাহ পাহলভী যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য সেনা বাহিনীর উপর ব্যপকভাবে নির্ভরশীল ছিলেন কিন্তু সেনাবাহিনী তাকে রক্ষা করতে পারিনি।

তাই বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খমেনি অনুভব করলেন এমন একটি বাহিনী গঠন করবেন যারা ক্ষমতাশনিদের যেকোনো মুল্যে রক্ষা করবে।এই জন্য নিয়মিত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী গঠন করেন।কাঠামোগতভাবে বিপ্লবী গার্ড বাহিনীকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে যা নিম্নরুপ:
  • স্থল বাহিনী
  • মহাকাশ বাহিনী
  • নৌ-বাহিনী
  • কুদস বাহিনী
  • বাসিজ
স্থল বাহিনী: এই বাহিনীর সংক্ষিপ্ত নাম হলো NEZSA যা বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর বা IRGC এর স্থল বাহিনী। এই বাহিনী অভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলা রোধে কাজ করে থাকে।

মহাকাশ বাহিনী: এই বাহিনী IRGC এর কৌশলগত ক্ষেপনাস্ত্র, বায়ু ও মহাকাশ পরিচালনা করে।২০০৯ সালে IRGC বিমান বাহিনী থেকে IRGC এরোস্পেস ফোর্স নামকরন করা হয়।

নৌ-বাহিনী: ১৯৮৫ সালে IRGC অধিনে নৌ-বাহিনীর সমান্তরালে নৌ সেবা পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বাসিজ বাহিনী: IRGC অধীনে ৪০ হাজার সদস্যের একটি আধাসামরিক বাহিনী আছে যার নাম বাসিজ।দেশের মধ্যে যদি কোনো সরকার বিরোধী কোনো বিক্ষোভ বা সরকার পতনের কোনো চেষ্টা করা হয় তাহলে তা কঠোর হস্তে দমন করে বাসিজ বাহিনী। ইরানের সর্বত্র এই বাসিজ বাহিনীর শাখা রয়েছে। 

শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি অফিস থেকে মসজিদ সর্বত্র বাসিজ বাহিনী তীক্ষ নজর রাখে।এছাড়া বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে রয়েছে বনিয়াদ নামে একটি দাতব্য সংস্থা,যারা ইরানের অর্থনিতীতে খুব প্রভাব বিস্তারকারী একটি প্রতিষ্ঠান। ইরানের তেল বর্হিভুত অর্থনিতীর প্রায় ২০ শতাংশ জিডিপি এই প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রনে। 
সামরিক বাহিনী ছাড়াও এদের রয়েছে হাউজিং, বাধ ও সড়ক নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান। আরোও রয়েছে তেল, গ্যাস, খাদ্য, পরিবহন, শিক্ষা ও সংস্কৃতিক প্রকল্প। বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর খাতাম আল আনবিয়া নামে ইঞ্জিয়ারিং কোরে লক্ষাধিক কর্মী রয়েছে যারা কোটি কোটি ডলারের অবকাঠামো নির্মানে কাজ করে থাকে। বিপ্লবী গার্ডের নৌ বাহিনী হরমুজ প্রনালীতে নিয়মিত নাজরদারি করে থাকে।

বিপ্লবী গার্ড এর যে বিমান বাহিনী রয়েছে তারা বিমান পরিচালনা না করলেও মিসাইল ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন করে থাকে। পশ্চিমা গন মাধ্যমগুলো বলছে তাদের হাতে ১০ টির বেশি ব্যালেস্টিক মিসাইল ব্যাটারি আছে।

কুদস বাহিনী: কুদস ফোর্স হলো IRGC বা বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বাহিনী যা ইরান সরকার তাদের পররাষ্ট্রনিতীর লক্ষ্য পুরনের জন্য মুল ভুমিকা পালন করে। দেশের বাইরে ইরানের পক্ষ হয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ড পরিচালনা করে। বলা হয়ে থাকে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাশ, ইয়েমেনের হুতি ও ইরাকি মিলিশিয়া বাহিনী তাদের হাতেই তৈরি হয়েছে।

তাদের অস্ত্র,প্রশিক্ষন দিয়ে বেশ দক্ষ ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যারা ইরানের ছায়া হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে।

ইরানের বিমান বাহিনী

ইরানের বিমান বাহিনীতে যে অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান রয়েছে তার সংখ্যা প্রায় ৫০৯ টি যার মধ্যে রয়েছে ফাইটার বিমান ১৪২ টি, অ্যাটাক বিমান ১৬৫ টি, হেলিকাপ্টার ১২৬ টি ও অ্যটাক হেলিকাপ্টার ১২ টি এর পাশাপাশি রয়েছে প্রশিক্ষন বিমান ১০৪ টি ও পরিবহন বিমান ৯৮ টি। তবে তাদের কাছে কোনো স্টেলথ বিমান নেয় তবে তা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে বলে ধারনা করা হয়।

ইরানের নৌ-বাহিনী

ইরানের নৌ-বাহিনী ২ ভাগে বিভক্ত যেমন: IRGC এর নৌ-বাহিনী ও নিয়মিত নৌ-বাহিনী। IRGC এর নৌ-বাহিনী Special কাজগুলো করে থাকে এজন্য তাদের নৌযান গুলো ছোট হয়ে থাকে এটা করার কারন হলো এতে করে তারা দ্রুত শত্রুকে আক্রমন করতে পারে।অন্যদিকে নিয়মিত নৌবাহিনীর কাছে রয়েছে ফ্রিগেট, সাবমেরিন ও মিশাইল এর মতো ভারি অস্ত্র। 
ইরানের কিছু যুদ্ধ জাহাজ রয়েছে যেগুলো ডেস্ট্রয়ারে কাজ করে। ইরানের কাছে মোট ৩৪ টি সাবমেরিন রয়েছে।ইরানের সাবমেরিনগুলো গাধির ক্লাস সাবমেরিন এগুলো প্রায় ২৯ মিটারের হয়ে থাকে এবং প্রতিটি সাবমেরিন ২ টি করে জাহাজ বিধ্বংসি টর্পেডো বহন করে সাথে থাকে ওয়াটার মাইন ও মিশাইল।

এই সাবমেরিনগুলো যেহেতু খুব ছোট তাই সহজেই এরা চোরাগুপ্তা হামলা করতে পারে শত্রু পক্ষের উপর। ইরানের মোট ২৩ টি গাধির ক্লাস সাবমেরিন রয়েছে।বড় আকারের সাবিমেরিনের মধ্যে ৩ টি কিলোক্লাস, ২ টি ফতেহ ক্লাস, ১ টি নাহাং ক্লাস,৪ টি যুগো ক্লাস ও ১ টি বিস্ট ক্লাস সাবমেরিন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রাশিয়ার তৈরি সাবমেরিন কিলো ক্লাস সাবমেরিন সবচেয়ে শক্তিশালী।

এদের নাম তারেক, নুর ও ইউনেস। প্রত্যেকটি সাবমেরিন ৫৩৩ মিলিমিটারের ১৮ টি টর্পেডো এবং ৮ টি মাইন ও বিমান বিধ্বংশি ৮ টি মিশাইল বহন করতে পারে। ইরানের রয়েছে ৭ টি ফ্রিগেট ও ৩ টি করভেট যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ জাহাজ হলো জামরান ক্লাস ফ্রিগেট। ইরানের কিছু মিশাইল বোট রয়েছে যেগুলো হেলিকাপ্টার ধ্বংশ করতে পারে।

তবে এর ভয়ংকর দিক হচ্ছে দ্রুত গতিতে চলন্ত অবস্থায় মিশাইল নিক্ষেপ করে। আবার কমান্ডো ইস্টাইলে বড় যুদ্ধ জাহাজগুলোকে অতি দ্রুত ঘিরে ফেলে আক্রমন করতে পারে।কারন দ্রুত এতগুলো বোটের মোকাবেলা করা কোনো যুদ্ধ জাহাজের দ্বারা সম্ভব না। এই বোট গুলো পরিচালনা করে বিপ্লবী গার্ড বাহিনী।

ইরানের পারমানবিক শক্তি

প্রায় শোনা যায় ইরান পারমানবিক অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম বা গোপনে পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করছে। বেশকিছু গনমাধ্যম বলছে ইরান পারমানবিক অস্ত্র তৈরির দ্বার প্রান্তে রয়েছে। পশ্চিমারা বলছে ২০১৮ সালে পরমানু বোমার উপাদান তৈরিতে লাগতো ১ বছর কিন্তু এখন লাগে মাত্র ১২ ‍দিন। ১৯৮৪ সালে চীন ও পাকিস্থানের সহায়তায় ইস্পাহান নগরীতে পারমানবিক গবেষনা কেন্দ্র চালু করে ইরান। 
১৯৯৮ সালে রাশিয়ার সাথে ইরান বুশের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর নির্মানের চুক্তি করে ও ২০০২ সালে চীনের সাথে ছোট ২ টি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর নির্মান করে। ২০০৬, ২০০৮ ও ২০১০ সালে পারমানবিক কেন্দ্রে নানা ধরনের বিপর্যয় দেখা দেয় কিন্তু ইরান এগুলোকে প্রপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দেয়। 
২০১৩ সালে টি-৫ প্লাস ওয়ান জোট ও ইরানের সাথে অন্ত:বর্তিকালীন সমঝোতার মাধ্যমে ইরানের পরমানু কর্মসুচি সিমীত করার শর্তে দেশটির উপর থেকে অবরোধ তোলা হয়। দুই বছরের আলোচনা শেষে ২০১৫ সালে ইরানের সাথে ৬ বিশ্বশক্তির পরমানু চুক্তি সই হয়।কিন্তু এই চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে বেরিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। 

পরমানু বোমা বানাতে ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ হতে হয় কিন্তু ইরানের কাছে আছে ৬০ শতাংশ। অতএব বোঝাই যাচ্ছে ইরান পরমানু অস্ত্র তৈরির দ্বার প্রান্তে পৈাঁছে গেছে।

ইরানের ক্ষেপনাস্ত্র শক্তি

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি রেঞ্জের ক্রজ মিশাইল রয়েছে রাশিয়ার পর ইরানের হাতে। মধ্যপ্রচ্যে ইরানের হাতে সবচেয়ে বেশি মিশাইল রয়েছে। ইরানের অর্ধেক মিশাইলের সমান মধ্যপ্রচ্যের সবগুলো দেশের কাছে নেয়।তবে ইরানের সর্বমোট কি পরিমান মিশাইল আছে তা কেউ বলতে পারে না বা সঠিক কোনো তথ্য নেই। আবার অনেক মিশাইল হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতিদের কাছে তুলে দিয়েছে ইরান। 
ইরানের কাছে পারমানবিক অস্ত্র না থাকলেও পারমানবিক হামলা করার মতো ব্যালেস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র রয়েছে। ইরান একমাত্র দেশ যারা পারমানবিক অস্ত্র ছাড়া দুরপাল্লার ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিশাইল তৈরি করেছে। 

বর্তমানে ইরানের কাছে ৩ পাল্লার মিশাইল আছে, যুদ্ধের মাঠে হামলা করার জন্য আছে আছে স্বল্প পাল্লার ও দুরে হামলা করার জন্য আছে শর্টরেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল বা SRBM এবং মিডিয়াম রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিশাইল MRBM । বর্তমানে ইরানের মিশাইলগুলো ইউরোপ পর্যন্ত আঘাত করতে সক্ষম।২০২৫সালের মধ্যে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেও হামলা করতে সক্ষম হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

ফাত্তাহ ১১০: সাম্প্রতিক সময়ে ইরান হামলা করতে ফাত্তাহ ১১০ ব্যবহার করেছে। ফাত্তাহ মিশাইলগুলো দামে অনেক সস্তা। এই মিশাইলগুলো ট্রাকে করে বহন করা ও নিক্ষেপ করা যায়। এই মিশাইলগুলো ৯ মিটার লম্বা ও ওজন সাড়ে তিন হাজার কেজি। মিশাইলগুলোতে সলিড ফুয়েল রকেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। যার ফলে এর গতি ও পাল্লা বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। ফাত্তাহ ১১০ এর ৪ টি জেনারেশন রয়েছে। 
খায়বার শেকে: ফাত্তাহ ১১০ এর পরে আরেকটি ক্ষেপনাস্ত্র ইরান তৈরি করেছে যার নাম খায়বার শেকে। ইরানের প্রিসিশন স্ট্রাইকি ব্যালিস্টিক মিসাইল হচ্ছে খায়বার শেকে। এই মিসাইলটি বড় ধরনের বিস্ফোরন না ঘটিয়ে কেবল একটা নির্দিষ্ট টার্গেটকে ধ্বংশ করবে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে এটি প্রদর্শন করে ইরান। এটিও সলিড ফুয়েল দ্বরা চালিত হয়। এর পাল্লা দেড় হাজার কিলোমিটার। এই মিসাইল সব ধরনের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে ধ্বংশ করতে সক্ষম। 

শাহাব স্কাড মিশাইল: ইরানের প্রথম দিককার মিসাইল হলো শাহাব সিরিজের স্কাড মিশাইল।১৯৯৮ সালে এই মিশাইল উত্তর কোরিয়ার সহযোগিতায় তৈরি করা হয়। এই মিশাইল তৈরি করার পর থেকে ইরানের মিশাইল প্রযুক্তিতে ব্যপক উন্নতি ঘটে। এই মিশাইলটি পারমানবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। মিশাইলটির অপারেশনাল রেঞ্জ দুই হাজার কিলোমিটার। 

মিশাইলটির ভয়ংকর দিক হচ্ছে এটা একসাথে ৫ টি ক্লাষ্টার মিউনিশন ওয়ারহেড বহন করে। ফলে একটি মিশাইল দিয়ে ৫ টি জায়গায় হামলা করা সম্ভব। এই মিশাইলের শেষ স্টেজে গতি প্রতি সেকেন্ডে ২.৪ কিলোমিটার।

কিয়াম ১: কিয়াম ১ ইরানের আরেকটি ভয়ংকর মিশাইল এবং এটি পারমানবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। এই মিশাইলটি ৭৫০ কেজি বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম। 

খোররামশাহ: ইরানের আরেকটি মিশাইলের নাম হচ্ছে খোররামশাহ যা খুব বড় সাইজের একটি মিশাইল ওজন হয় প্রায় ২০ টন। এই মিশাইলের রেঞ্জ ২ হাজার কিলোমিটার ও বিস্ফোরক বহন করতে পারে ১৮০০ কেজি। এই মিশাইলের বৈশিষ্ট্য হলো শব্দের থেকেও ১৬ গুন দ্রুত গতিতে উড়তে পারে। যা ইরান থেকে নিক্ষেপ করলে ১ মিনিটে ইসরাইলে আঘাত করতে পারবে। 

গদর-১১০: ইরানের সবচেয়ে স্মার্ট মিশাইল হলো গদর-১১০ এটি মুলত শাহাব ৩ মিশাইলের আপডেট ভার্সন। এর বৈশিষ্ট্য হলো ইরানের অন্য যেকোন মিশাইলের থেকে দিক বদল করতে পারে।যারফলে এন্টি ব্যালিস্টিক মিশাইল দিয়ে এটাকে ঠেকানো যায় না। এছাড়া আধা ঘন্টার মধ্যে মিশাইলটিকে নিক্ষেপ করার জন্য প্রস্তুত করা যায়। 

এটি শব্দের থেকে ৯ গুন বেশি গতিতে ছুটতে পারে ও এটিকে ইন্টার্নাল গাইডেন্স কিংবা জিপিএসের সাহায্যে দুই উপায়ে নিয়ন্ত্রন করা যায়। আমেরিকা ঘাঁটি ও ইসরাইলের মাথা ব্যাথার কারন হলো গদর-১১০ মিশাইলটি।মিশাইলটি মহাকাশে থাকা স্যাটেলাইট ধ্বংশ করতে পারবে। এই মিশাইলের রেঞ্জ ৩ হাজার কিলোমিটার।

ফাজর: ইরানের সবচেয়ে অ্যাডভান্স মিশাইল হচ্ছে ফাজর।এটি ইরানের প্রথম ও একমাত্র মিশাইল যা মাল্টিপল ইন্ডিপেন্ডেন্টলি টার্গেটেড রি-এন্ট্রি ভেহিকল বা MIRV বহন করতে পারে। একসাথে ৩ টি MIRV ওয়ারহেড বহন করে মিশাইলটি। এই মিশাইলটির ব্যাপারে ই কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। এর রেঞ্জ সম্পর্কেও কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। 

তবে ধারনা করা হেয় এটি ২৫০০ থেকে ৫০০০ কিলোমিটার রেঞ্জের। 

সেজ্জিল: সবচেয়ে শক্তিশালী মিশাইল হচ্ছে সেজ্জিল। এই মিশাইলের পাল্লা ২ থেকে ২.৫ হাজার কিলোমিটার রেঞ্জের।যা পূর্ব ইউরোপে ক্ষমতা রাখে এই মিশাইল। এটি শব্দের গতি থেকে ১৪ গুন বেশি গতিতে ছুটে চলে ও বিস্ফারক বহন করতে পারে দেড় হাজার কেজি। যাতে পারমানবিক ওয়ারহেড ভরলে ধ্বংশযজ্ঞ ব্যাপক ঘটাতে পারবে। 

সেজ্জিলের আপডেট ভার্সন হলো আশুরা। এই মিশাইলটিকে পাকিস্থানের পারমানবিক অস্ত্রবাহী শাহিন-২ ব্যালিস্টিক মিশাইলের সমকক্ষ ধরা হয়ে থাকে। কিয়াম-১ নামক ক্ষেপনাস্ত্রনির পাল্লা ৭০০ কিলোমিটারের বেশি যা ৭৫০ কেজি ওজনের বিস্ফোরক বহনে সক্ষম।এটি ২০১৭ সালে আই.এস এর বিরুদ্ধে বহন করেছিলো ইরান।

ইরানের ড্রোন শক্তি

অতীতে ইরানের ড্রোনগুলো ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল।ইরানে হামলা করতে কিংবা নজরদারী করতে আসা ড্রোনগুলো ভুপাতিত করতো ইরান।সেই ভুপাতিত করা ড্রোন গুলোর প্রযুক্তি উদ্ধার করে ইরান নিজেরাই ড্রোন তৈরি করে।পাশাপাশি তারা ড্রোন প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে থাকে।
শাহেদ ১২৯ ড্রোন: শাহেদ ১ টুয়েনটি নাইন দিয়ে ইরান সবচেয়ে বেশি হামলা চালিয়েছে। সিরিয়া যুদ্ধে এই ড্রোন বেশি ব্যবহার করা হয়। এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের MQ-1 PREDATOR ড্রোনের কপি বলা হয়ে থাকে। ধারনা করা হয়ে থাকে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোনটি ভুপাতিত করার পর সেটার প্রযুক্তি পুনরুদ্ধার করে এই ড্রোনটি তৈরি করে। 

সম্প্রতি এই ড্রোনটির আপডেট ভার্সন তৈরি করেছে ইরান। ২৬ ফিট লম্বার ড্রোনটি ৪ শত কেজির বিস্ফোরন বহন করতে পারে, ৪ টি সাদিদ গাইডেড বোমা বহন করতে পারে। ড্রোনটির কমব্যাট রেঞ্জ ১ হাজার ৭ শত কিলোমিটার অর্থাৎ ইরান থেকে উড়ে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ জায়গায় হামলা করতে পারে। একটানা ২৪ ঘন্টা উড়তে পারে ড্রোনটি।

শাহেদ-১৩৬ বা কামিকাজে ড্রোন: শাহেদ-১ থার্টি সিক্স ড্রোনের দৈর্ঘ্য ১১.৫ ফুট প্রস্থ ৮ ফুট, ওজন ৪৪০ পাউন্ড সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১১৫ মাইল, পাল্লা ১১০০ থেকে ১৫০০ মাইল এই ড্রোনটির নাকের ‍দিকে একটি ওয়ারহেড রয়েছে এবং ক্যামেরাও রয়েছে। 

এই ড্রোনটি কামিকাজে ড্রোন নামেও পরিচিত। এই ড্রোনটি ৫০ কেজি বিস্ফোরক বহনে সক্ষম।

শাহেদ ১৩১ ড্রোন: শাহেদ ওয়ান থার্টি ওয়ান ড্রোনের দৈর্ঘ্য ৮ ফুট প্রস্থ ৭ ফুট, ওজন ৩০০ পাউন্ড শাহেদ ওয়ান থার্টি ওয়ান শাহেদ ওয়ান থার্টি সিক্সের পুর্ববর্তী সংস্করন। দুই ড্রোনের ধরন একই রকমের।

সায়েগেহ ২ ড্রোন: এটি ইরানের একমাত্র স্টেলথ ড্রোন যা শত্রুর রাডারে ধরা পড়েনা ড্রোনটি। ধারনা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিনের তৈরী RQ 170 ড্রোনের প্রযুক্তি থেকেই এই ড্রোন তৈরী করেছে ইরান। তাই বলা হয় এই ধরনের উচ্চ প্রযুক্তিসম্পুর্ন স্টেলথ ড্রোন কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান কার্যকরভাবে সার্ভিসে আনতে পেরেছে। তবে ড্রোনটি একটি মিশাইল ধারন করে।

মাহাজের ড্রোন: এই ড্রোনটি ইরানের ছোট আকৃতির একটি ড্রোন। সাধারনত ছোট ছোট অপারেশনের জন্য ব্যবহার করে ইরান এর বিস্ফোরক বহন ক্ষমতা ১০০ কেজি।

হামাসে ড্রোন: এই ড্রোনটিকে নিয়ে কোনো তথ্য কাউকে দেয়নি ইরান।

কামান-২২ ড্রোন: এই ড্রোনটি ৩ হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে হামলা চালাতে পারে। এটা সবচেয়ে বেশি রেঞ্জের ড্রোন।তবে এই ড্রোনটি নিয়ে ইরান বেশি তথ্য প্রকাশ করেনি। এই ড্রোনটি ৩০০ কেজি বিস্ফোরক বহন করতে পারে। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন এই ড্রোনটি যুক্তরাষ্ট্রের MQ 9 এর সমতুল্য হতে পারে। এই MQ 9 যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সেরা ড্রোন।

গাজা ড্রোন: ইরানের সবচেয়ে আধুনিক ড্রোন হলো গাজা ও সব থেকে বড় কমব্যাট ড্রোন। ড্রোনটি শাহেদ ১৪৯ নামেও পরিচিত। ফিলিস্তিনের গাজা ভুখন্ডের নামানুসারে নামকরন করা হয়েছে। এটা ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতা সম্পুর্ন ড্রোন। এই ড্রোন তৈরির মাধ্যমে ইরান ড্রোন তৈরিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গিয়েছে। 

এই ড্রোনটি একসাথে ১৩ টি বোমা বহন করতে পারে এবং ৫০০ কেজি ওজন বহন করে। একটানা ৩৫ ঘন্টা আকাশে উড়তে পারে ড্রোনটি। বর্তমান যুগে অন্যান্য ড্রোনগুলোর তুলনায় একটানা উড়ার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। কারন বর্তমানে আধুনিক ড্রোনগুলো একটানা ২৪ ঘন্টা উড়তে পারে সেখানে গাজা ড্রোনটি একাটানা ৩৫ ঘন্টা উড়তে পারে। 

ড্রোনটির স্বাভাবিক গতি ঘন্টায় ৩৫০ কিলোমিটার।এই ড্রোনটি ৩৫ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়তে পারে। ফলে শত্রুর রাডার ফাঁকি দিয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে পারে। এর রেঞ্জ ২ হাজার কিলোমিটার। 

এই  ড্রোনটি দিয়ে সৌদিআরব, ইরাক, কুয়েত, কাতার ও আরব আমিরাতেরে মার্কিন ঘাঁটি গুলোতে হামলা করা সম্ভব এবং হরমুজ প্রনালী ও পারস্য সাগর নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।পুরো মধ্য প্রাচ্য এই ড্রোনটির আওতার মধ্যে রয়েছে।

ফট্রোস ড্রোন: এই ড্রোনটি সার্ভিসে আসার অপেক্ষায় আছে। এই ড্রোন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করা না হলেও ধারনা করা হয় এটির রেঞ্জ হবে ২ হাজার কিলোমিটার।

লেখকের শেষকথা

বন্ধুগণ এতক্ষণে আপনারা জেনে গেছেন ইরানের সামরিক বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের পরিমান। বর্তমানে যে দেশ যত বেশি আধুনিক অস্ত্র রয়েছে সে দেশ তত বেশি উন্নত এবং এই অস্ত্রের জোরেই তারা বিশ্বকে নিজের করতলগত করে রেখেছে। নিশ্চয়ই আপনারা খুশি হয়েছেন তথ্যনির্ভর এই আর্টিকেলটি পড়ে।

উপরের আর্টিকেল থেকে যদি আপনি সামান্য পরিমাণ উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনার বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে শেয়ার করবেন এবং কমেন্ট করতে ভুলবেন না।আবারও এই ধরনের আর্টিকেল পেতে ভিজিট করুন আমাদের এই সাইটে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সব মিলবে ডট কমের নিতীমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা যায়

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩